Wednesday, April 26, 2023

মুক্তাগাছার পাটনীদের জীবন যাত্রায় চলমান উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি


মোঃ মাহমুদুল হাসান: মুক্তাগাছা উপজেলা থেকে প্রায় ১২কিলোমিটার দূরে বাঁশাটি ইউনিয়নের ছোট্র একটি গ্রামের নাম শিবরামপুর। যাকে পাড়া পাটনীপাড়া বলে সকলেই চিনে। পেশার নামের যোগ হয়ে সম্প্রদায়ের নাম হয়েছে পাটনী । সেখান থেকেই পাটনী পাড়া। এ পাড়ার মানুষ যুগ যুগ ধরে পরিবারের সবাই মিলে  বাঁশ শিল্পের কাজ করে যাচ্ছেন। বাঁশের জিনিসপত্র তৈরীর মধ্যেই যুগ যুগ ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে তাদের জীবন যাত্রা। তাদের সংসার চালানোর জন্য পরিবারের উপার্জনের প্রধান উৎসই বাঁশের শিল্পের কাজ। সারা বিশ্বের মতো  উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ কিন্ত  চলমান উন্নয়নের খুব একটা  ছোঁয়া লাগেনি পাটনীদের  জীবন যাত্রায়।


পাটনীদের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে ঘাট পাটনীরা এ পাড়ায় বসবাস করে। ঘাট পাটনীদের পূর্ব পুরুষরা নদ-নদীতে নৌকা দিয়ে মানুষ পারাপারের কাজ করতো । এটাই ছিল তাদের প্রধান পেশা। নদ-নদী অস্তিত্ব বিলিন হওযায় তাদের রোজগারেও ভাটা পড়ে। পরে তারা জীবন-জীবিকার জন্য এ বাঁশ শিল্পের কাজকেই প্রধান কাজ হিসাবে  বেছে নেয়। ভিটে মাটি ছাড়া এ পাড়ার কারো  নিজস্ব কোন জমাজমি নেই।

যদিও পরিবেশগত কারণে প্লাস্টিক শিল্পের চাপে বাঁশশিল্পের ধস নেমে এসেছে। তবুও  দেশ থেকে নিপুন হাতের তৈরী বাঁশ শিল্পের নানা উপকরণ দেশ-বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে ।

মুক্তাগাছার কাশিমপুর ইউনিয়নের পাটনীপাড়া এ গ্রামের প্রায় ৪০-৫০টি পরিবার বাঁশ দিয়ে কুলা, চালনি, ঢালি, চাটাই, চাউল মাপার সের, মাছ ধরার চাঁই, গালই, ভাইর, পলো, চালনী, খাঁচা, বাঁশের মোড়া তৈরির কাজ করে থাকে।

সম্প্রতি বাঁশ শিল্পের এই পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, পাড়ার প্রায় সব বাড়িতেই বাঁশ শিল্পের কাজ চলছে। বাড়ির পুরুষেরা ব্যস্ত থাকে বাঁশ প্রক্রিয়াজাত করার জন্য আর নারী ব্যস্ত থাকে বিভিন্ন জিনিস তৈরী জন্য। বহু বছর ধরে এ গ্রামের মানুষেরা বাঁশের কাজ করে আসছে। তাদের এই বাঁশ শিল্পের তৈরি জিনিসপত্র উপজেলার বিভিন্ন হাট বাজারে বিক্রি করা হয়। এছাড়াও বাড়ি থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গার পাইকাররা এসেও কিনে থাকেন। এই বিক্রির টাকা দিয়েই তাদের সংসার চলে। এছাড়া অন্যকোন কাজ এ পাড়ার মানুষদের জানা নেই।

পাটনীপাড়ার গ্রামের রাধারানী (৬৫) বয়সের ভারে নজ্জু হলেও সংসারের হাল ধরতে হয়েছে তার। বিয়ের পর শাশুড়ীর কাছ থেকে এ বিদ্যা শিখে প্রায় ৩০ বছর সময়ে বেশি এ বাঁশ শিল্পের কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের ঘরে রয়েছে দুই সন্তান। প্রায় ২০ বছর পূর্বে স্বামী মারা যাওয়ার পর এ বাঁশ শিল্পের কাজ করেই সংসারের চালান। সারাদিনে একটি চাউল মাপার সের তৈরি করে ১০০ টাকা রোজগার করেন তিনি। তা দিয়েই সংসার চালান।

রিনা রাণী দাশ দৈনিক আমাদের সংবাদ পত্রিকার এ প্রতিনিধিকে জানান, পৈত্রিকসূত্রেই তার স্বামী এ কাজ পেয়েছে। এ কাজের জন্য বাজার থেকে বা অন্যগ্রাম থেকে বাঁশ কিনে আনা হয়। বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করে কোন মতে চলছে তাদের সংসার।

সরেজমিনে পাটনীপাড়া এলাকার গিয়ে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি বাড়ির উঠানেই নারীরা-পুরুষের পাশাপাশি বসে কাজ করছেন। গল্প করছে মুখ দিয়ে কাজ করছে হাত দিয়ে। কেউ কেউ পাশে মোবাইলে গান চালিয়ে দিয়েছেন, তাতে উচ্চস্বরে গান বাজছে। শিশুরাও সহযোগিতা করছে বড়দের কাজে। পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে দেশ এগিয়ে গেলেও আর্থিক অনটনের কারনে জীবন যাত্রায় এখানে খুব একটা আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। শীতের সকালে আপন উঠোনে রোদ পোয়াতে পোহাতে নিবৃষ্ট মনে কাজ করছিলেন সুধীর চন্দ্র তরণী দাশ (৫০)। তিনি জানান,  প্রায় তিন দশক ধরেই এই কাজ করছেন তারা। বাবা-দাদার হাত ধরে তার এই কাজে হাতেখড়ি। পরে তিনি তাঁর স্ত্রী ও সন্তাকে শিখিয়েছেন।

তিনি বলেন, “আমি আমার জীবনে আর কোনো কাজ করি নাই। বাঁশের কাজ ছাড়া আর কিছুই পারি না যে, সেই কাজ করে খাব। কী করব ভাই, আমরাতো গরিব মানুষ। আমাদের দিকে কেউ তাকায় না । এই বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র বানিয়ে কোনো মতে চলেআমাদের সংসার।

সজিব দাশের জানান, করোনাকালীন সময়ে রোজগারে ভাটা পড়ায় ৩ সন্তানকে নিয়ে কোনমতে খেয়ে না খেয়ে তাদের দিন কাটছে। অথচ সরকারি সহায়তার কোন কিছুই জুটছে না তাদের ভাগ্যে। বিভিন্ন সময় সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা তাদের তালিকা তৈরি করে সহযোগিতার কথা বললেও মেলেনি কোন সাহায্য। “এ বছর মাঘের কনকনে শীতে একটা কম্বলও জুটেনি তার।

পড়ালেখার পাশাপাশি সংসারের হাল ধরতে বাঁশ শিল্পের কাজ করছেন শান্ত দাশ (১৪)। স্থানীয় একটি স্কুল থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে সে। পড়ালেখার পাশাপাশি বাবা-মাকে এ কাজে সাহায্য করে ।

এ অঞ্চলে দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষদের নিয়ে বেশ কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) কাজ করছে। তবে ঋণ দানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাদের কর্মকান্ড। অধিকাংশই ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে কাজ করেন। তবে এই শিল্পের উন্নয়নের জন্য কোনো সংস্থা থেকে ঋণ বা সহযোগিতা পাননি শ্রমজীবীরা।

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: